প্রকাশিত: Tue, Apr 23, 2024 1:53 PM
আপডেট: Thu, Jul 10, 2025 9:30 PM

উপজেলা নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয়স্বজনকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশনা কার্যকর হবে কি

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ; সারাদেশে চলছে তীব্র দাবদাহ। মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে গেছে গরমে। বাংলাদেশের তাপমাত্রা এখন যে জায়গায় পৌঁছেছে, তাতে মরুভূমির দেশগুলোকেও হাড় মানাচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে একধরনের স্থবিরতার মধ্যেও সরকারি দলে কিছু উত্তেজনা আছে, তীব্র গরম আছে এবং নানা ধরনের ঘটনা ঘটছে। আসন্ন উপজেলা নির্বাচন প্রভাব মুক্ত রাখতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয়-স্বজনকে প্রার্থী না হতে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু দলের অনেক স্থরেই দলীয় প্রধানের সেই নির্দেশনা মানার কোনো লক্ষণ ছিলো না। পরিস্থিতি এতই সংঘাতময় যে, এখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে আনুষ্ঠানিকভাবে বলতে হয়েছে, যারা প্রার্থী হয়েছেন তাদের তালিকা তৈরি করতে। 

উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে প্রায় সব উপজেলায় দলীয় কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কোথাও কোথাও  এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয়স্বজনের সাথে বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। 

আমরা জানি যে এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিলো নাটোরে। নাটোর জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে এবং  জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে থেকে অপহরণ করে মারধর করে মৃতপ্রায় করে ফেলা হয়েছে সিংড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রার্থী দেলোয়ার হোসেনকে। আক্রমণকারীদের বেশির ভাগ যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ এবং শ্রমিক লীগের নেতাকর্মী। অপহরণ কাজে ব্যবহৃত মাইক্রোবাস জব্দ করেছে জেলা পুলিশ। উদ্ধারের সময় মাইক্রোবাসের ভেতর থেকে বিপুল পরিমাণ ধারালো অস্ত্র ও সিংড়া উপজেলা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাঈদ আহমেদ পলকের শ্যালক মো. লুৎফর হাবিব রুবেলের লিফলেট, স্টিকার, ক্যালেন্ডার সম্বলিত পোস্টার ও ছবি জব্দ করা হয়েছে। জব্দকৃত মাইক্রোবাসটির মালিকও রুবেল। 

বোঝাই যাচ্ছে যে এই অপহরণ ও মারধরের সাথে কে  জড়িত। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝতে পেরে শ্যালক রুবেলকে সরে দাঁড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী পলক এবং তিনি আহত চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীকে দেখতেও গিয়েছিলেন। দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোনো এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয়-স্বজনরা নির্বাচন করতে পারবে না। কোন্দল আর শত্রুতা এমন পর্যায়ে গেছে যে, এখন ওবায়দুল কাদেরকে বলতে হয়েছে, ‘আপনারা সরে দাঁড়ান’। কিন্তু আমরা ভালো করেই জানি, এই নির্দেশ হয়তো অনেকেই মানবেন না। তাদের তেমন কিছু হবেও না। কারণ আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় শৃঙ্খলা বলতে এখন আর কিছুই নেই। প্রায় সব জায়গায় এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয়-স্বজন নির্বাচনের মাঠে আছেন এবং তারা প্রভাব বিস্তারের অপচেষ্টা করেই যাচ্ছেন। 

গত সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। ফলে আওয়ামী লীগ নিজের সিদ্ধান্তে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করতে নিজেদের নেতাদেরই স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড়ানোর অনুমতি দিয়েছিলো এবং জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুষ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্ধিতামূলক করে ভোটার উপস্থিতি দেখাতে দলীয় প্রার্থীর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থীর এ আয়োজন ছিলো আওয়ামী লীগের একটি কৌশল। কিন্তু তৃণমূলে তৈরি হয়েছে বিভক্তি। সেই বিভেদের জেরে  এখনো কোনো কোনো জায়গায় সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। এখন উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে  সেই বিভেদ আরো বেশি করে দেখা যাচ্ছে। প্রথম ধাপের ১৫০টি উপজেলা নির্বাচনের অন্তত ৩০টিতে এমপি-মন্ত্রীদের ঘনিষ্ঠ স্বজনরা নির্বাচনী প্রার্থী হয়েছেন। যাদের মধ্যে সন্তান, আপন ভাই, চাচাত ভাই, ফুফাত ভাই সহ নানা ধরনের আত্মীয়স্বজন রয়েছেন। এর বাইরে আত্মীয়তার অথবা গোষ্ঠী সূত্র ধরে অনেকইে আছে। 

আওয়ামী লীগে কোন্দল কেন? এ প্রশ্নের একটি সহজ উত্তর হলো দলে কোনো রাজনৈতিক চর্চা নেই, আছে কেবল ক্ষমতা। আর এটি করতে গিয়ে দলটি আসলে সরকারের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। এমপিদের দলীয় পদে না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো কতবার, কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। দল এবং সরকার আলাদা করার কথা বলা হলেও কার্যকর হয়নি। এগুলোই দলের ভেতরে নানা ধরনের সংঘাত তৈরি করেছে। এর বাইরে আছে আধিপত্য, পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্ব, কমিটি বাণিজ্য, পদ বাণিজ্য ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে দলে সেই অর্থে কোনো রাজনৈতিক শৃঙ্খলা অবশিষ্ট নেই। এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয়-স্বজন যে কত নির্বাচন করছে সেই তালিকা কিন্তু আজ পর্যন্ত পরিষ্কার হয়নি।  প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় স্থানীয় সংসদ সদস্য বা মন্ত্রীদের বিরাট প্রভাব থাকে। প্রশাসনেও তারা সে প্রভাব বিস্তার করে। আর সেই সুযোগে অনেক এমপি-মন্ত্রী তাদের আত্মীয়-স্বজনদের উপজেলা নির্বাচনে দাড় করিয়েছে এবং দাড় করাতে চান। কারণ নির্দিষ্ট এলাকাটি নিয়ন্ত্রণে আনতে চান। বিষয়টি হলো সেই এলাকার আধিপত্য তার পরিবারের হাতে থাকবে। আওয়ামী লীগের হাতে থাকবে এমন কোনো কথা নেই, পরিবারের হাতে থাকলেই হবে। সেটি করতে গিয়েই তারা নিজের আত্মীয়-স্বজনদের প্রধান্য দিয়ে থাকে। 

যদি সরে দাঁড়াবার নির্দেশনা কার্যকর না হয়, তাহলে এর পরিণতি হবে দলের জন্য ভয়ংকর। উপজেলা নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয়স্বজনরা যদি নির্বাচত হয়ে আসেন তাহলে স্থানীয় রাজনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পরতে বাধ্য। দলীয় কোন্দল বাড়ার পাশাপাশি অনেক উপজেলায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই আসলে হবে না। দেখা যাক নির্দেশনা অনুযায়ী তালিকা কতটা তৈরি হয় এবং তা কতটুকু কার্যকরি হয়।  

পরিচিতি: সিনিয়র সাংবাদিক। সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার ফেসবুক পেজের ভিডিও কনটেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন সঞ্জয় চন্দ্র দাস